রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৫ অপরাহ্ন

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা চায় নতুন ইসি

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা চায় নতুন ইসি

স্বদেশ ডেস্ক:

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভাবনায় রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে নতুন নির্বাচন কমিশন। গতকাল সোমবার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই প্রথম সভায় আগামী নির্বাচন নিয়ে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার।

সূত্র জানায়, দায়িত্ব গ্রহণ করেই প্রথমে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। এ সময় নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। বৈঠকে তাদের প্রথম ভোট, কুমিল্লা সিটি নির্বাচন, এরপর রংপুর সিটি নির্বাচন ও সর্বোপরি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় সরকারের দুটি সিটি নির্বাচন নতুন ইসির জন্য আস্থা ফেরানো ও গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের প্রাথমিক ‘পরীক্ষা’।

সুষ্ঠু ভোট গ্রহণে ইসির ভূমিকা প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘নতুন ইসির কাছে সবাই সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করছে। কিন্তু কাজটি চ্যালেঞ্জিং। ইসির একার পক্ষে সম্ভব নয়। নির্বাচনকালীন সরকারের কথা সংবিধানে বলা আছে। তারা (ওই সরকার) যদি চান তা হলে ইসির পক্ষে ভালো ভোট করা সম্ভব। সেই সরকারের কতটুকু সদিচ্ছা আছে, সেটা দেখার বিষয়।’

সাবেক এই সিনিয়র সচিব আরও বলেন, ‘বিএনপিসহ প্রায় অর্ধেক রাজনৈতিক দল ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নেয়নি। সার্চ কমিটির কাছেও তারা নাম প্রস্তাব করেনি। জাতীয় পার্টিও বলছে এই কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ। দেশের প্রায় অর্ধেক লোকের নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা নেই। আপাতত সামনে বড় কোনো নির্বাচন নেই। দু-একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন ইসিকে আস্থা অর্জনের পাশাপাশি গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।’

এদিকে দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, সেজন্য দেশের রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের মধ্যে ‘সমঝোতায়’ আসার আহ্বান জানিয়েছেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘আমরা অনুনয়-বিনয় করব, আপনারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করুন।’

তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা নির্বাচনটা সুন্দরভাবে পরিচালনা করবেন। ওখানে সহিংসতা থাকবে না। কেউ কাউকে বাধা দেবে না।’

শপথ নেওয়ার পরদিন গতকাল আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে এসে দায়িত্ব বুঝে নেন নতুন নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন হাবিবুল আউয়াল। চার নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা এমিলি ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খানও এ সময় তার পাশে ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে দায়িত্বটা রয়েছে, সেটা যদি পালন না করেন, তা হলে নির্বাচন কমিশন এককভাবে যে কাজ করবে, সেখানে সীমাবদ্ধতা দেখা দেবে। আমাদের দায়িত্ব আছে। রাজনৈতিক নেত্বত্বকে আমরাও সহযোগিতা করব।’

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সহায়তা না করে, পলিটিক্যাল লিডারশিপের যদি ন্যূনতম সমঝোতা না থাকে, আমি তো তাদের মুরব্বি হতে পারব না। উনারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী, অনেক বেশি অভিজ্ঞ।’

দায়িত্ব গ্রহণের দিন তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচনকে অর্থবহ করার জন্য স্ব স্ব অবস্থান থেকে করণীয় পালন না করে, তখন উনারা নিজেদের প্রশ্ন করবেন, নাকি আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করবেন? আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করলে আমি সবিনয়ে বলব, আমাদের ক্ষমা করবেন। আপনাদের কিছু যদি ব্যর্থতা থাকে, তবে সেটাও স্বীকার করুন। সবাই যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রি-স্টোর করুন। একটা ভালো সংসদ উপহার দিতে চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না।’

আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় থাকে, সেই নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিইসি বলেন, ‘বিএনপি যদি এমন ঘোষণা দিয়েও থাকে, আমরা কী তাদের চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাব না? কোনো কথাই শেষ কথা নয়।’

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে দূরত্ব কমে আসে। আমরা যদি মুখ ফিরিয়ে থাকি, তা হলে কিন্তু দূরত্ব বাড়তে থাকবে। আলোচনা করতে হবে। কাউকে না কাউকে অহংকার পরিত্যাগ করে আলোচনায় আসতে হবে। নির্বাচন কমিশনের শক্তি অসীম নয়। এটা সবসময় আপেক্ষিক।’

বিরোধী দলগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মাঠ ছেড়ে চলে গেলে হবে না। মাঠে থাকবেন। কষ্ট হবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। যেখানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, কিছুটা ধস্তাধস্তি হয়।’

নতুন সিইসি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, পরের প্রজন্মের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সংসদ উপহার দেওয়া।’ তিনি বলেন, ‘সকলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে একটি দ্বান্দ্বিক সংসদ গড়ে উঠুক। আমরা সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে গুড গভার্নেন্স ও ভালো সংসদ গড়ে তোলার চেষ্টা করব। এদিক থেকে আমাদের কোনো কার্পণ্য থাকবে না।’

‘আগামী নির্বাচনে ভোট রাতে হবে না দিনে হবে’ এমন এক প্রশ্নের জবাবে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘সেটা সময়ই বলে দেবে। যদি রাতে হয়ে থাকে, আপনারা যেটা বলছেন, সেটা অতীতের কথা, আমি জানি না। যখন আগে ভোট হয়, আমি দিনেই দিয়েছি। রাতের ভোট দিনের ভোট সেই এপিসোডে যেতে চাই না। আমাদের দিকে তীর লক্ষ্য করে রাখেন, যদি দেখেন আমরা সেটা করি, আমাদেরকে তীরবিদ্ধ করেন, আপত্তি করব না।’

বিএনপির নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি নিয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, নির্বাচন সরকার করে না। নির্বচানের সময় একটা সরকার থাকে। কোনো না কোনো সরকার থাকবেই। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ছিল, নির্দলীয় সরকার ছিল। এখন যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা আছে, সেটা মেনেই আমরা চেষ্টা করব, ভোটাররা যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সেটা বড় চ্যালেঞ্জ।

সংবাদ সম্মেলনে সিইসি জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পর কমিশনের প্রথম দিনের বৈঠক ছিল মূলত নিজেদের মধ্যে পরিচিতি পর্ব। কমিশনের কর্মপরিধি সম্পর্কে সচিব আমাদের অবহিত করেছেন। আমরা খুব অভিজ্ঞ নই। আমি একেবারেই নতুন, তবে গণমাধ্যমে নির্বাচনের খবর দেখেছি। নির্বাচন ঘরে বসে পর্যবেক্ষণ করেছি। কিছুটা অস্বচ্ছ হলেও ধারণা আছে। আমরা প্রত্যাশা করি, সকলে নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতন্ত্রকে সুসংহত করবেন। যারা নির্বাচন করবেন তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব কমিশনের রয়েছে। কর্মপদ্ধতি কী হবে সেটি ঠিক করিনি। তবে জানতে কিছু জ্ঞান আহরণ করেছি।

এদিকে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন দিয়েই নতুন কমিশনের প্রথম পরীক্ষা শুরু হবে। এই পরীক্ষা নিরপেক্ষতার মধ্যে উতরে গেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করা এই কমিশনের জন্য স্বস্তির হবে বলে মনে করছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটির ভোট হয়। ওই বছরের ১৭ মে প্রথম সভা বসে। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ধারা ৩৪ অনুযায়ী গত বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে আগামী ১৬ মে তারিখের মধ্যে অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ১৮০ দিনের মধ্যে এ সিটি নির্বাচনের আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। এটাকে ভিত্তি ধরে কমিশন তাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা না থাকলে দ্রুতই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে নতুন কমিশনকে।

এদিকে গতকাল দায়িত্ব গ্রহণের প্রথমদিন সকালে সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনারদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে বরণ করেন ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরপরেই ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন নতুন কমিশনাররা। বেলা সাড়ে ১১টায় নির্বাচন ভবনের কনফারেন্স রুমে ইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু হয়। এ সময় ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার নতুন কমিশনকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।

এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল, নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আহসান হাবীব খান, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান বক্তব্য রাখেন। পরে ইসির কর্মকর্তারা কমিশনের কার্যক্রম বিষয়ে নতুন কমিশনকে অবহিত করেন।

এ সময় সিইসি সবাইকে সঠিকভাবে দায়িত্বপালনের নির্দেশনা দেন। বৈঠকে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ূন কবীর, আইডিয়া প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কাশেম মো. ফজলুল কাদেরসহ ইসির কর্মকর্তারা অংশ নেন।

বৈঠক শেষে নতুন কমিশন সংবাদ সম্মেলন করেন। এরপরে তারা নিজ নিজ কক্ষে অবস্থান করেন। এদিন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফাইলে তারা স্বাক্ষর করেননি। বিকালে নতুন কমিশনের সদস্যরা ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপরে তারা আর নির্বাচন কমিশনে ফেরেননি। আজ সকাল ১০টায় নতুন ইসির সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা রয়েছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877